বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি সম্পূর্ণ ভালো হয়| Bipolar Disorder|

 

বাইপোলার অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বাইপোলার ডিসঅর্ডার চিকিৎসা| বাইপোলার পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার| ম্যানিক ডিসঅর্ডার

 



আপনি কি কখনও খুব খুশি, আবার কখনও খুব বিষাদগ্রস্ত? এই ভালো, এই হতাশ? 

ডাক্তারদের ভাষায় এই মুড সুইং কে কি বলে, আপনি জানেন?

ডাক্তাররা একজন ব্যক্তির বাইপোলার অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারকে এমনই একটি অবস্থা হিসাবে বর্ণনা করেন যেখানে একজন ব্যক্তির মেজাজ বা আবেগ দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবর্তিত হয়।মেজাজ পরিবর্তনের এই রোগটিকে মনোবিদরা বাইপোলার ডিজঅর্ডার নামে অভিহিত করেছেন। 

এর অর্থ হলো যে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনও কখনও বিষাদগ্রস্ত বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিপর্যস্ত থাকেন। কখনও কখনও এটি কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। দেখা যায় একই ব্যক্তি একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করতে শুরু করে। সে সময় তিনি অত্যধিক প্রাণোচ্ছল হয়ে পড়েন। এই মুড সুইং কে মানসিক বিশেষজ্ঞরা যে নাম দিয়েছেন তাই হলো বাইপোলার অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার। 

 

বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি সম্পূর্ণ ভালো হয়?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বংশগত এবং পরিবেশগত কারণগুলির মধ্যে একটি জটিল সম্পর্কের ফলাফল।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মনোরোগ চিকিৎসকদের মতে, একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ- অনেকটা ডায়াবেটিস এর মত। ওষুধ ও চিকিৎসা দিয়ে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না।

তাই মেজাজ পরিবর্তনের এই রোগটিকে  খুব হালকা করে নেওয়ার সুযোগ নেই ।

 

বাইপোলার অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার কী?

 

বাইপোলার মানে দুই মেরু বা দুই প্রান্ত। অন্য কথায়, একজন ব্যক্তির মানসিকতার একটি এপিসোডে অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যাকে ডাক্তাররা ম্যানিয়া এপিসোড বলে। রোগী এ পর্যায়ে খুব আনন্দিত, অনেক কথা বলে ।

যদিও তা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, আর যদিও হয় তবে তার জন্য কোন কাজে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়  এটি তার জন্য যে কোন বিষয়ে শেষপর্যন্ত অ্যাটেনশন বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। 

অন্য এপিসোডে তাকে দেখা যায় বিষন্ন বা হতাশ , যাকে ডাক্তাররা ডিপ্রেশন এপিসোড বলে। এ সময় তার কিছুই ভালো লাগে না, বিষন্নতায় ভোগেন, দুঃখ ভারাক্রান্ত বোধ করে। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও রয়েছে।

এই দুইয়ের মধ্যে রোগী ভালো থাকে। সে সময় তিনি অন্য সব মানুষের মতোই স্বাভাবিক আচরণ  করেন |

বাইপোলার ডিসঅর্ডার কেন হয়?

 

বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার প্রকৃত কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এর পেছনে কিছু উপাদান কাজ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের এর তথ্য মতে, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে অন্তত একজন তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভোগেন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন যে বাইপোলার ডিজিজ প্রায়ই বংশগত কারণে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চলে যায়।

সাধারণত মস্তিষ্কে সেরোটোনিন, ডোপামিন, নোরাড্রেনালিন ইত্যাদি নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, মানসিক অসুস্থতার ভুল চিকিৎসা ইত্যাদি কারণে বাইপোলার হতে পারে।

বয়ঃসন্ধিকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব আরও বেড়ে যায় বলে মনোবিদরা মনে করেন। 

রোগটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে। আশ্চর্যের বিষয়,  উপসর্গটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হতে পারে।

 

এ  ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত রোগী দিনের পর দিন দরজা বন্ধ করে রাখতে পারে, অনেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বাইরে বেরোতে  চায় না, অনেকে পরিবারের আত্মীয়-স্বজন সাথে ঠিকমত কথা বলে না, ঠিকমত খেতে চায় না। 



আবার দেখা যায় একই ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করা শুরু করে বাড়িতে পার্টি করে। বন্ধুদের সাথে বাইরে বেরোয় অনেক সময় ইচ্ছামত দরকারি কিংবা অদরকারি জিনিস কেনা শুরু করে, রাতে ঘুম কম হয় অনেকে টাকা খরচের কোন হিসেবে রাখে না। এসব রোগীকে অনেকেই প্রথমে মাদকাসক্ত বলে ধারণা করে থাকতে পারে ।  কিন্তু যখন বুঝতে পারে এটি একটি মনোরোগ তখন তারা বিভিন্ন মনোবিদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। তখন চিকিৎসকরা চিহ্নিত করেন এই রোগীটির বাইপোলার ডিজঅর্ডার আছে। 


 

ভুক্তভোগী এক রোগী জানায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পর তার আচরণে কিছুটা উন্নতি ঘটে।  তবুও এখনো মাঝে মাঝে মেজাজ বদলে যায়, অকারণে কেনাকাটা করার অভ্যাস কিংবা মন খারাপ হয়ে যাওয়াটা কে এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।  তার পরেও  আগের থেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে।  তিনি আরো বলেন তার আচরণে পরিবর্তন প্রায়ই তার কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারের সদস্যের সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 

 

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ

যেহেতু এই ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দুই ধরনের মেজাজ বা আচরণ প্রকাশ করে, তাই বাইপোলার ডিসঅর্ডার উপসর্গকেও দুই ধরনের বলা যেতে পারে। সময়ের সাথে সাথে একই ব্যক্তির মধ্যে এই ধরনের বিপরীত আচরণ পরিলক্ষিত হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত।

 

ম্যানিক ডিসঅর্ডার পর্ব

অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, খুব হাসিখুশি মনোভাব, অতিরিক্ত কথা বলা, নিজেকে প্রচণ্ড শক্তিশালী, নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করা, উচ্চ শক্তি বা অতিরিক্ত কাজ, খাবারের প্রতি ঘৃণা, অযৌক্তিক কথা বা  অপ্রয়োজনীয় কিছু চাওয়া, চিন্তা করা, অনিদ্রা, ঘুমাতে ইচ্ছে না করা, হঠাৎ রাগ, ঝগড়া বা মারামারি, বেপরোয়া মনোভাব, অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ইচ্ছা ,বেশি খরচ  করতে শুরু করা, ফোকাস হারান, যৌন ইচ্ছা বৃদ্ধি, নিজের জিনিসপত্র অন্যের হাতে তুলে দেওয়া,

 

ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডার

বিষণ্ণতা ম্যানিয়ার ঠিক বিপরীত। বাইপোলার ডিসঅর্ডার হল এমন একটি অবস্থা যেখানে একই ব্যক্তি এই ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতায় ভোগেন।


🤎 দীর্ঘদিন ধরে বা দীর্ঘ সময় ধরে বিষণ্ণতায় ভোগা

🤎 অকারণে কাঁদা, উদ্বিগ্ন হয়ে পরা

🤎 আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা,

🤎 সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা

🤎 আত্মহত্যার প্রবণতা, জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা

 

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রকারভেদ

একজন ব্যক্তির চারটি ভিন্ন ধরণের  বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মধ্যে যেকোনো একটি দেখা দিতে পারে । যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স  অন মেন্টাল ইলনেস NAMI-এর মতে, উপসর্গগুলি একটি স্পেক্ট্রাম আকারে ঘটে এবং  এ রোগের প্রকার গুলোর মধ্যে অনেক সময়ই সুস্পষ্ট পার্থক্য বোঝা  সম্ভবপর হয় না | 

বাইপোলার 1 ডিসঅর্ডার

 

বাইপোলার 1 ডিসঅর্ডার মানে আপনার কমপক্ষে 1টি ম্যানিয়া এপিসোডের এক সপ্তাহ ধরে স্থায়ী হতে দেখা যায়;  চিকিৎসা ছাড়া অধিকাংশ আক্রান্ত ব্যক্তি এই সময়ের মধ্যেই বিষন্নতার এপিসোড আক্রান্ত হতে পারে যা চিকিৎসা ছাড়া ছয় থেকে বারো মাস ব্যাপী স্থায়ী হতে পারে 

পর্বের চরম উচ্চতা (ম্যানিয়া) 1 সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হবে। ম্যানিয়া 3-6 মাস স্থায়ী হতে পারে যদি চিকিত্সা না করা হয়। বেশিরভাগ লোক এই সময়ের মধ্যে বিষণ্নতা অনুভব করবে যা চিকিত্সা ছাড়াই 6-12 মাস স্থায়ী হতে পারে।

বাইপোলার 2 ডিসঅর্ডার

 

বাইপোলার 2 ডিসঅর্ডার ম্যানিক এবং ডিপ্রেশন উভয় পর্বের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর ক্ষেত্রে যে মেনিয়া অনুভূত হয় তা সাধারণত বাইপোলার ওয়ান এর থেকে কম গুরুতর হয় এবং এটি মেনিয়া এপিসোড এর আগে বা পরে বেশি মাত্রায় বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে অভিজ্ঞতা কম গুরুতর — তাই নাম হাইপোম্যানিয়া। 

 

সাইক্লোথাইমিক ডিসঅর্ডার

 

সাইক্লোথাইমিক ডিসঅর্ডারে, আপনি দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে ম্যানিক এবং ডিপ্রেশন উভয় পর্বই অনুভব করেন। শিশুদের ক্ষেত্রে, একই কথা সত্য, তবে তাদেরকে এক বছর ধরে উভয় এপিসোডের অস্তিত্ব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই ব্যাধিতে ম্যানিয়া এবং বিষণ্ণতা সাধারণত বাইপোলার 1 বা বাইপোলার 2 এর চেয়ে কম গুরুতর হয়। সাইক্লোথাইমিক ডিসঅর্ডার অস্থির মেজাজ সৃষ্টি করে, যার অর্থ ম্যানিয়া এবং বিষণ্নতার সাথে মিশ্রিত স্বাভাবিকতার সময়কাল থাকতে পারে।

 

হাইপোম্যানিয়ায় আক্রান্ত একজন ব্যক্তি স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে এবং ভালভাবে কাজ করতে পারে, কিন্তু তাদের মেজাজ স্থিতিশীল থাকে না এবং রোগীটি প্রায়শই ডিপ্রেশনে পড়ার ঝুঁকি থেকে যায় 

NAMI যেমন ইঙ্গিত করে, বাইপোলার II ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বাইপোলার I ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনায়  অধিক বিষন্নতার এপিসোড অনুভব করতে পারে।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার হল একটি মস্তিষ্কের ব্যাধি যার ফলে মেজাজ, শক্তি এবং কাজ করার ক্ষমতার চরম পরিবর্তন হয়। যদিও গবেষণা এই রোগটিকে বোঝার অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে কিন্তু এই রোগটির সঠিক কারণ নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি 

 

বাইপোলার ডিজঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তিকে কিভাবে সহায়তা করবেন : একটি সহায়ক গাইড

 

১. বাইপোলার ডিসঅর্ডার সম্পর্কে জানুন

২.  আক্রান্ত ব্যক্তিকে বোঝার চেষ্টা করুন

৩. বাইপোলার ডিসঅর্ডারের  এই রোগের চিকিৎসায় উৎসাহ যোগান

৪.  আপনি যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না তা মেনে নিন

৫. আক্রান্ত ব্যক্তির  মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করুন

৬.  এটা বুঝতে চেষ্টা করুন যে শুধু মেডিকেশন বা ওষুধ এর মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়

৭. শুধুমাত্র আপনার সঙ্গীর অসুস্থতার উপর ফোকাস করবেন না

৮. আশা রাখুন , পজিটিভ হন

 

বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগের চিকিৎসা

মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ ডাঃ পরামর্শ দেন যারা এই বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত তারা যেন খুব দ্রুতই  মানসিক ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করেন

তিনি আরো বলেন আমরা বলছি না যে সঠিক চিকিৎসা পেলে এ রোগ দ্রুত সেরে যাবে তবে যদি রোগীটি নিয়মিত চিকিৎসা পায় ঠিক যেমনটি ডায়াবেটিসের রোগীরা পেয়ে থাকে তাহলে এ রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকটাই সম্ভব হতে পারে

 

একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বলেন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সেবা ও সঠিক পরিচর্যা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ  এ রোগটি সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

 একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হচ্ছে এ ধরনের রোগীর সাথে তর্কে জড়ানো এড়িয়ে চলতে হবে এবং কোন কাজে তাকে বাধ্য করা যাবে না

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *