কেন এবং কিভাবে গিরগিটি রং বদলায়? |’ক্যামেলিয়ন্স’ বা গিরগিটি তার শরীরের তাপমাত্রাকে বাইরের তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য করতে তার রঙ পরিবর্তন করে। ইরিডোফোরস নামক নির্দিষ্ট ত্বকের কোষের বিন্যাস পরিবর্তন করে তারা রঙ পরিবর্তন করে। এই কোষগুলিতে ন্যানোক্রিস্টাল রয়েছে যা তাদের শারীরিক অভিযোজনের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রতিফলিত করে। কেন এবং কিভাবে গিরগিটি তাদের রঙ পরিবর্তন করে- তা বিখ্যাত সায়েন্স এবিসি ওয়েবসাইট থেকে চলুন আমরা জেনে নেই —
গিরগিটির রঙ-পরিবর্তন ক্ষমতা সবসময়ই মানুষকে কৌতূহলী করে তুলেছে। আমরা প্রায়শই চিন্তা করি যে আমরা যদি আমাদের রঙ পরিবর্তন করতে পারতাম, আমাদের চারপাশের সাথে মিশে যেতে পারতাম এবং গিরগিটির মতো নিজেকে ছদ্মবেশ দিতে পারতাম তবে জীবন কতটাই না ‘কুল এন্ড ইজি হতো। এটি অবশ্যই আমাদের আরও সহজে ‘অকওয়ার্ড সিচুয়েশন্স’ থেকে নিজেকে ‘এসকেপ’ করতে সাহায্য করতো !
কিভাবে গিরগিটি তার রঙ পরিবর্তন করে?
অক্টোপাস এবং কাটলফিশের তাদের কোষে থাকা পিগমেন্ট ‘মূভ এরাউন্ড’ করে রঙ পরিবর্তন করে, অপরদিকে গিরগিটিদের ‘ইরিডোফোরস’ নামক বিশেষ কোষ তাদের জন্য এই রঙ পরিবর্তন এর কাজ করে থাকে । নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে কিভাবে পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, চারটি প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা এবং চারটি কিশোর প্যান্থার গিরগিটি তাদের রঙ পরিবর্তন করেছে। তারা দেখতে পেল যে গিরগিটিদের এই ইরিডিসেন্ট কোষ ইরিডোফোরস-এর দুটি স্তর রয়েছে ।
এই ইরিডোফোরগুলির মধ্যে পিগমেন্টস এবং ন্যানোক্রিস্টাল রয়েছে যা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে প্রতিফলিত করে। গিরগিটি তার ত্বককে উত্তেজনাপূর্ণ বা শিথিল করে, ইরিডোফোরসের উপরের স্তরের ঘনত্ব পরিবর্তন করে তার রঙ পরিবর্তন করে।
একটি গিরগিটির ত্বকে কয়েকটি ভিন্ন ধরণের কোষ রয়েছে যা এর রঙে অবদান রাখে। উপরের স্তরটি এমন কোষের সমন্বয়ে গঠিত যেখানে হলুদ রঙ্গক রয়েছে—জ্যান্থোফোরস—এবং যে কোষগুলিতে লাল রঙ্গক রয়েছে—এরিথ্রোফোরস— প্রধানত ডোরাকাটা অঞ্চলে থাকে। এই স্তরের নীচে ইরিডোফোরস রয়েছে, যেগুলি কীভাবে ‘প্যাক করা এবং অর্ডার করা’ হয়েছে তার উপর নির্ভর করে আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে থাকে। ফাইনালি, শেষ স্তরটি মেলানোফোরস দ্বারা গঠিত। এই মেলানোফোরের এমন এক্সটেনশন রয়েছে যা ত্বকের উপরের স্তরে পৌঁছায়।
যখন একটি গিরগিটি একটি শিথিল অবস্থায় থাকে, তখন ত্বকের ন্যানোক্রিস্টালগুলি একে অপরের কাছাকাছি থাকে এবং তারা নীলের মতো ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। যখন একটি গিরগিটি উত্তেজিত হয়, তখন ন্যানোক্রিস্টালগুলির মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তারা লাল, কমলা এবং হলুদের মতো দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। এই রঙগুলি গিরগিটির শরীর জুড়ে ডোরাকাটা ব্যান্ডগুলিতে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। একটি গিরগিটির সবুজ রঙ হল ‘হলুদ এবং নীল’ ওয়েভলেংথস এর ফলাফল। জ্যান্থোফোরস থেকে প্রতিফলিত হলুদ এবং ইরিডোফোরস থেকে প্রতিফলিত নীল আলোর ফলে এদের রঙ সবুজ হয়।
এদের শিথিল ও নিরপেক্ষ অবস্থায়, তারা হালকা সবুজ এবং প্রাণবন্ত থাকে । আর যখন গিরগিটি চাপা মেজাজে থাকে, যেমন যখন লুকানোর প্রয়োজন হয়, গিরগিটি ‘ডার্ক শেড’ এ পরিণত হয়, কখনও কখনও গাঢ় বাদামী হয়ে যায়। এটি মেলানোফোরস তাদের এক্সটেনশনের মাধ্যমে উপরের স্তরগুলিতে পিগমেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন : বেশি দারুচিনি খেলে কি হয়?। দারুচিনি খাওয়ার উপকারিতা ও নিয়ম
গিরগিটি রং বদলায় কেন?
কেন গিরগিটি তার রঙ পরিবর্তন করে? জেনে আশ্চর্য হবেন- গিরগিটি কিন্তু ‘ক্যামোফ্লাজ’ বা ছদ্মবেশের জন্য তাদের রঙ পরিবর্তন করে না, যেমনটি বেশিরভাগ লোকেরা মনে করে।। গিরগিটি রা তাদের বেশিরভাগ সময় গাছেই কাটায়, বাদামী শাখা এবং সবুজ পাতার মধ্যে উঁচু জায়গায়। তাদের নিজস্ব সবুজ এবং বাদামী বর্ণগুলি তাদের পাতার পটভূমিতে মিশে যেতে সাহায্য করে, তবে তাদের রঙ পরিবর্তন করার ক্ষমতা কিন্তু এটির উদ্দেশ্যে নয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গিরগিটি দুটি প্রধান কারণে তাদের রঙ পরিবর্তন করে – প্রথমত যোগাযোগ রক্ষা করতে এবং দ্বিতীয়ত তাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে।
প্রাণীরা একে অপরের সাথে যোগাযোগের বিভিন্ন উপায়ে বিবর্তিত হয়েছে। মানুষ প্রাথমিকভাবে ভাষা ব্যবহার করে, ফায়ারফ্লাইরা আলো ব্যবহার করে এবং গিরগিটিরা রঙ ব্যবহার করে। গিরগিটির রঙ পরিবর্তন তার মেজাজ নির্দেশ করতে পারে। একটি রাগান্বিত গিরগিটি গাঢ় রঙ ধারণ করে, যেখানে শিথিল মেজাজে থাকা একটি গিরগিটি একটি হালকা রঙ ধারণ করে।
২০১৩ সালের একটি গবেষণায় অন্যান্য পুরুষদের সাথে প্রতিযোগিতার সময় পুরুষ গিরগিটির রঙের দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল। গবেষকরা রিপোর্ট করেছেন যে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রঙের ধরণ তাদের প্রতিযোগীদের কাছে বিভিন্ন সংকেত পাঠিয়েছে। গাঢ় মাথার ( ডার্ক হেড) পুরুষ গিরগিটিদের লড়াইয়ে জেতার সম্ভাবনা বেশি ছিল, অন্যদিকে প্রতিযোগিতার সময় উজ্জ্বল স্ট্রাইপযুক্ত পুরুষ গিরগিটিদের তাদের প্রতিপক্ষের কাছে প্রথম এপ্রোচ করার হার বেশি ছিল।

এটি প্রধানত এমন কিছু যা পুরুষ গিরগিটি করে। পুরুষরা সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য তাদের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। একটি পুরুষ গিরগিটি মহিলাকে কতটা স্বাস্থ্যকর এবং সেক্সি তা দেখানোর জন্য হালকা রঙে স্যুইচ করবে, অথবা সে অন্য পুরুষকে দেখলে তার রঙ গাঢ় করতে পারে। একটি গিরগিটি, প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে, আধিপত্য জাহির করার জন্য তার রঙ গাঢ় রঙে পরিবর্তন করে।
মহিলা গিরগিটিদেরও রঙ পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে, তবে তারা সীমিত। তারা তাদের পুরুষ সহযোগীদের তুলনায় বরং নিস্তেজ-রঙের। কিছু গিরগিটি তাদের রং পরিবর্তন করার অন্য কারণ হল তাপমাত্রা। একটি ঠান্ডা গিরগিটি আরও তাপ শোষণ করতে ডার্ক হয়ে যায় , আর একটি হট গিরগিটি তার শরীর থেকে আরও তাপ প্রতিফলিত করার জন্য হালকা রং হয়ে থাকে । উদাহরণস্বরূপ, প্যান্থার গিরগিটি ইয়েমেনের মতো খোলা, শুষ্ক পরিবেশে পাওয়া যায়।
এই গিরগিটিতে উপস্থিত ইরিডোফোরস সূর্যালোকের শোষণ হ্রাস করতে সাহায্য করে, যা বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে একটি গাঢ় রঙ প্রায়শই সকালের সময় উপস্থিত ছিল। গবেষকরা উপসংহারে পৌঁছেছেন যে এটি গিরগিটির জন্য ‘বাস্কিং টাইম’ ( উষ্ণতা এবং আলোর সংস্পর্শে রোদ পোহান., সাধারণত সূর্য থেকে, শিথিলতা এবং আনন্দের জন্য) কমাতে পারে।
আরো পড়ুন : গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে ২০২২ এ কীভাবে অনলাইনে অর্থ উপার্জন শুরু করবেন
গিরগিটি ছাড়াও রং বদলায় যেসব প্রাণী
এমনটা কি হয় – কেউ আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেই আপনি গিরগিটির কথা টেনে আনেন? আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছেন যারা সময়ে অসময়ে গিরগিটির মতো রং বদলান। গিরগিটির নিজের শরীরের রং পরিবর্তন করতে পারে মাত্র দুই মিনিটে। কি এমন তাড়া এদের?
মূলত বিপদ থেকে নিজেকে সেভ করার জন্যই নিজের রঙ বদল করে তারা। তবে জানেন কি? গিরগিটি ছাড়াও পৃথিবীতে এমন অনেক প্রাণী রয়েছে যারা নিজের রং বদলাতে পারে। শিকারীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বা নিজের শিকার ধরতে এভাবেই এরা রঙ বদলায়।
সি হর্স , গোল্ডেন টরটোয়েজ বিটল , ট্রি ফ্রগ, মঙ্কফিশ, ফ্লাউন্ডার ফিশ, মিমিক অক্টোপাস এইসব প্রাণী নিজের রং বদলাতে পারে অনায়াসে !
শেষকথা
গিরগিটি এবং অন্যান্য প্রাণীর রঙের পরিবর্তন এর বিষয়টি এখনও পুরোপুরি বোঝা যায় না। জটিল ‘ন্যানোক্রিস্টাল লাট্টিসেস’ থেকে শুরু করে চোখের পলকে পিগমেন্ট বিচ্ছুরণ পর্যন্ত, প্রাণীরা যে জটিল উপায়ে রঙ পরিবর্তন করে তা অত্যাশ্চর্য, চিত্তাকর্ষক এবং পুরোদস্তুর ম্যাজিক্যাল !