যেভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি ৪ লাখ টাকা মাসে ইনকাম লিজার!

পড়াশোনা, সংসার—সব কিছু গোছালো এক হাতে সামলান তিনি। এরই ফাঁকে করেন নিজের ভালোলাগার ফ্রিল্যান্সিং। বর্তমানে গড়ে তুলেছেন ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর প্রতিষ্ঠান লিডিং লাইট। মাসে আয় করেন চোখ কপালে ওঠা – চার লাখ টাকা। নিজের সফলতার এই গল্প শুনিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের শিক্ষার্থী সিনথিয়া আক্তার লিজা স্বনামধন্য এক দৈনিককে। প্রতিবেদক মুহাম্মদ শফিকুর রহমান-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।

যেভাবে তার শুরু

এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ার সময়ই লিজা জানতে পারেন জনপ্রিয় এই ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে । ‘উডেমি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনলাইন কোর্স করেন। এ ছাড়া ইউটিউবে ফ্রিল্যান্সিং সংক্রান্ত ভিডিওগুলো দেখতে থাকেন মনোযোগ দিয়ে । তাঁর প্রথম করা কোর্সটি ডিজিটাল মার্কেটিংসংক্রান্ত।মাত্র ছয় মাসের মধ্যে লিজা এই কাজ রপ্ত করেন। এরপর আর তিনি পেছন ফিরে তাকান নি । ক্ষুদ্র্র ব্যবসায়ী বাবা মেয়ের আগ্রহ দেখে কম্পিউটার কিনে দেন।

লিজার প্রথম কাজ


তাঁর মাত্র পাঁচ ডলারের প্রথম কাজ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্লায়েনটের । সাত দিনে তিনি প্রথম কাজটি শেষ করে ক্লায়েন্টকে বুঝিয়ে দেন। বিনিময়ে ক্লায়েন্ট তাঁকে ফাইভ ষ্টার রিভিউ দেন। লিজা জানান, প্রথম কাজেই এই পজিটিভ রিভিউ আমাকে অনুপ্রাণিত করে।

ফ্রিল্যান্সিং কেন করেন ?


ঘরে বসে কাজ করা এবং বাইরে যাওয়ার ঝামেলা না থাকায় ফ্রিল্যান্সিং বেছে নিয়েছেন। নেই কোনো ধরাবাধা টাইমটেবিল, নিজের সময়মতো কাজ করার সুবিধা থাকায় তিনি ফ্রিল্যান্সিং বেছে নিয়েছেন বলে জানান লিজা। এখানে চাকরির মতো নির্দিষ্ট আয়ের তো নিশ্চয়তা নেই— প্রশ্নের জবাবে লিজা বলেন, নির্ধারিত কোনো আয়ের নিশ্চয়তা না থাকলেও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারলে আপনার কিছু রিপিট ক্লায়েন্ট হতে বাধ্য, তাঁরাই আপনাকে রিপিটেডলি কাজ দেবেন।

যত চ্যালেঞ্জ


আর বাকি দশটা কাজের মতো ফ্রিল্যান্সিংয়েও আছে চ্যালেঞ্জ। লিজা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, – সঠিক গাইডলাইন, পরিবার থেকে সমর্থন না পাওয়া, ইংরেজি না জানা—এগুলোই বড় চ্যালেঞ্জ। কিভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে ফেস করবে নতুনরা ? লিজা বলেন, এটা নিজের ওপরই নির্ভর করে । প্রথমত, একটা যথার্থ গাইডলাইনের জন্য তাদের ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে কাজে নামতে হবে। দ্বিতীয়ত, ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিষয়টি যেহেতু আমাদের অভিভাবকদের এখনো পরিষ্কার না, তাই তাঁদের বোঝাতে হবে।

লাখপতি লিজা


বছর তিনেকের মধ্যেই লিজার আয় লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সর্বনিম্ন দুই লাখ, সর্বোচ্চ মাসে চার লাখ টাকা !। গত মাসেই লিজার আয় ছিল তিন হাজার ডলার। লিজা বলেন, আয় মূলত নির্ভর করে কাজের ওপর। কাজ বেশি করতে পারলে আয় বেশি হয়। জানুয়ারি ২০২১ সালে তিনি ওপেন করেন ‘কিছু করতে চাই’ (https://web.facebook.com/groups/1023907671454569) নামে একটি ফেসবুকে গ্রুপ। সদস্য ৪০ হাজার।

কাজের ফিরিস্তি


২০১৯ সাল থেকে লিজা কাজ করেন ডিজিটাল মার্কেটিং এই ক্যাটাগরি নিয়ে। তাঁর বেশির ভাগ ক্লায়েন্টই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, বিভিন্ন দেশের। তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রমোশন, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে সাইটগুলোর অ্যাড ক্রিয়েট করাই কাজ। এসব ক্লায়েন্টের সঙ্গে তিনি মাসিক চুক্তিতে কাজ করেন। বর্তমানে ‘ডার্মা ফার্ম ইউএস’ নামের একটি বিউটি কম্পানিতে তিনি তাদের মার্কেটার হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া মার্কেটপ্লেসে বিভিন্ন বায়ারের সঙ্গে তাঁর কাজ রয়েছে।

লিডিং লাইট


লিজার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার নাম ‘লিডিং লাইট’। তিনি এখানে শুধু মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে তাঁর তিন মাস মেয়াদের কোর্স চালু আছে। কোর্স ফি পাঁচ হাজার টাকা। গুগল মিট এর মাধ্যমে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস নেওয়া হয়।তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন
শাকিলা ইসলাম গত মাসে আয় করেছেন এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা। ফারজানার এক মাসে আয় ৮০ হাজার টাকা। তিনিও লিজার কাছ থেকে কাজ শিখেছেন।

মোবাইলে বাজিমাত


আপনি হয়তো জানতে চান – ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার ছাড়াও ফ্রিল্যান্সিং হয় নাকি? এমনটাই বেশির ভাগ মানুষের ধারণা। লিজা এমন ধারণার বাইরে কিছু করে দেখিয়েছেন। মোবাইল দিয়ে মেয়েদের কাজ শেখান লিজা – ‘আমার আইটি সেন্টারে শুধু মোবাইল দিয়ে মেয়েদের কাজ শিখাচ্ছি। ফ্রিল্যান্সিং মানে সেই পুরোনো ধারণা গ্রাফিকস ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন নয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ের অনেক শাখা আছে, যেমন—ডিজিটাল মার্কেটিং, রাইটিং অ্যান্ড ট্রান্সলেশন, ডাটা অ্যান্ট্রি— এসব কাজের প্রায় ৭০ শতাংশ ফোন থেকেই করা যায়। আর আমার টার্গেট হলো, মেয়েরা যেন ফোন থেকে কাজ করে নিজের টাকায় ল্যাপটপ কিনতে পারে।’ লিজা জানান, মোবাইল থেকে ফেসবুক মার্কেটিং অ্যান্ড অ্যাডভারটাইজিং, ইনস্টাগ্রাম মার্কেটিং অ্যান্ড অ্যাডভারটাইজিং, টুইটার, পিন্টারেস্ট, ইউটিউব মার্কেটিং অ্যান্ড অ্যাডভারটাইজিংয়ের সব কাজ করা যায়। খুব ভালো পরিমাণ আয়ও সম্ভব।

লাখপতি হওয়ার সহজ উপায়


শুধু ধৈর্য আর কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। একজন নারী যদি লাখপতি হতে চান তাঁকে সবচেয়ে বেশি ধৈর্য ধরতে হবে। কাজ শেখার পাশাপাশি শেখার বিষয়টিকে অবহেলা করা যাবে না। শুরুতে হয়তো পাঁচ দশ ডলার দিয়ে হতে পারে। তবে লেগে থাকলে পাঁচ ডলার থেকে ১০০০ ডলার হতে সময় লাগবে না। মার্কেটপ্লেসে উত্থান-পতন হতেই পারে। তাই বলে কখনোই হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না – বলেন তিনি । তার মতে, অবশ্যই সব ধরনের ক্লায়েন্টকে ভালোভাবে হ্যান্ডল করার যোগ্যতা থাকতে হবে।

প্রতারিত হওয়া থেকে যেভাবে বাঁচবেন


ব্যাঙের ছাতার মতো ফ্রিল্যান্সিং শেখার এজেন্সি গড়ে উঠেছে। এক মাসেই লাখপতি, এমন চটকদার বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। নতুনরা যেন এসব বিজ্ঞাপনের ভাষায় প্রতারিত না হন, সে উপায় লিজা বাতলে দিয়ে বলেন, নতুন যাঁরা ফ্রিল্যান্সিং করতে আসবেন তাঁদের জন্য একটাই কথা, তাঁরা যেন আগে ফ্রিল্যান্সিং কী, কিভাবে করতে হয়, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যে ক্যাটাগরিগুলো আছে সেগুলো সম্পর্কে ইউটিউব এবং গুগল থেকে জেনে নেন। যদি কেউ এই বিষয়গুলো জেনে নেন, তাহলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে না ।

পড়াশোনা, সংসার, ফ্রিল্যান্সিং


লিজা একজন শিক্ষার্থী,এবং ফ্রিল্যান্সার। সব কিছু সামলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে তাঁর লাখ টাকা আয়। এত কিছু একসঙ্গে কিভাবে সম্ভব? লিজার মুখেই শোনা যাক, কিভাবে তিনি সব সামলাচ্ছেন। ‘পড়াশোনা, সংসার সামলে ফ্রিল্যান্সিং করা বেশ কঠিন। যেহেতু স্বামী খুব সাপোর্টিভ, তাই এ বিষয়ে আমাকে একেবারেই কষ্ট করতে হয়নি। আমরা দুজন মিলেই সংসারের সব কাজ করি।’

নারী ফ্রিল্যান্সারদের যত ভুল


লিজার মত হচ্ছে, নারী ফ্রিল্যান্সারদের একটি বিশেষ ভুলই আমি উল্লেখ করতে চাই, তা হলো অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলা। ধৈর্য না থাকলে এই সেক্টরে টিকে থাকা খুব মুশকিল।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা


ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে ভবিষ্যতে নিজের দেশকে উপস্থাপন করতে চান লিজা। পরিচিত হতে চান উদ্যোক্তা হিসেবে। খুব ইচ্ছা আছে, নিজের ব্যবসাকে বড় একটা ব্র্যান্ডে পরিণত করার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *